১লা আগষ্ট ১৯৯৭ইং রোজ শুক্রবার, সন্ধ্যে ৬টা ২৫মিনিট
সারাটা দিন যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ছিলাম তা অতিবাস্তব করে দিয়ে চলে গেলেন আমার দাদাজান আব্দুর রহিম জোয়ারদার। দিন সাতেক আগেই আমার এসএসসি’র ফলাফল শুনে যে দাদাজান, বাবাকে বারবার বলছিলেন, “ওকে ডাক্তার বানাস বাবুল, ওকে ডাক্তার বানাস। ওর মাথা খুব শার্প।” সেই দাদাজান নির্বাক হয়ে গেলেন আজীবনের জন্য। আমার কথাটা একটা বারের জন্যেও ভাবলেন না?
শেষের দেড় মাসে আপনার সাথে যে মধুর সময় গুলো কাটিয়েছিলাম তা বোধহয় আপনার আর কোন নাতি-নাতনিই পারেনি। আপনার আর দাদীজানের যুগলবন্দী জীবনের প্রথম দিককার কথাগুলো বোধহয় শুধুমাত্র আমার সাথেই মজার মজার কথায় ভাগ করে নিয়েছিলেন। আপনাকে বদরাগী বলে জ্ঞান করেই আপনার বড় ছেলে, আমার বাবা আজীবন আপনার থেকে দূরে দূরেই থেকে গেলেন। কিন্তু আমি জানি আপনি কতটা মজার মানুষ ছিলেন। কতটা বড় ছিলো আপনার মন আর মনের জোর। আপনার থেকে পাওয়া সেই শক্তিটাকে সম্বল করেই আজো আমি জীবনের পথে সচল। আপনি আমাকে কিছু না বলেই হুট করে চলে যেতে পারেন, কিন্তু আপনাকে আমি ভুলি কি করে বলতে পারেন?
৬ই আগষ্ট ২০১১ইং রোজ শনিবার, রাত ১১টা ৩৫মিনিট
বাসায় ঢুকলাম এই একটু আগেই। নেয়ে-খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি মাত্রই। ফুপাতো ভাই আওরঙ্গজেব মুঠোফোনে বাবাকে গ্রামের বাড়ীতে যাবার অনুরোধ জানাচ্ছেন। রাত তিনটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে আরিচা রোডে দাঁড়ালে গাড়ীতে তুলে নেবেন বলছেন। বুঝলাম মাথার উপর থেকে আরো একজন মুরুব্বীর স্নেহের-আদরের-ভালোবাসার-মমতার চিরশীতল ছায়াটা সরে গেলো।
বছর পাঁচেক হলো, বাবা সাধারনত এ ধরনের সংবাদ সরাসরি আমাকে দেন না, কমসে কম ঘন্টা চারেক পর করে মা’কে দিয়ে অনেক ভাবে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলান। আজো তাই। চুপচাপ বারান্দায় এসে হাঁটছিলেন। মাঝে আমার জানালায় বার দু’য়েক ঊঁকিঝুঁকি দিলেন। বাবাকে আমিই সহজ করে দিলাম — “আব্বা, কে মারা গেলেন?”
না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমার বাবার চাচাতো বড় ভাই, আমার প্রিয় চাচাদের একজন আকমল চাচাজান, আকমল জোয়ারদার। চার বছর আগে দাদাজানের কবরে জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম, আপনি অতি আদরে কাছে ডেকে নিয়ে আমার খোঁজ নিয়েছিলেন… খুউব মনে আছে। কাছে বসিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বলছিলেন বারবার। আপনার আম্মা, দাদীজান তখনো বেঁচে। দু’জনেই আমার বাবাকে বাবুল নামে একডাকে চিনতে পারছিলেন কিন্তু আমার সাথে কি যেনো মেলাতে পারছিলেন না। বারবার বলছিলেন ২০০১ এ আপনাদের দেখা আমি আর ২০০৭ এর আমি নাকি এক নই। মাথার ঘন চুল গিয়ে সেখানে বিশাল চকচকে টাক, হাঁটাচলায় স্থবির আর নিস্তেজ ভাব, শারীরিক ভঙ্গিমায় অবসাদ সব মিলিয়ে আমি যেনো কেমন হয়ে গিয়েছি, ঠিক যেনো আমার বড় দাদাজানের (দাদার বড়ো ভাই) মতো হয়ে গিয়েছি।
দাদা কে তাঁর মায়ের পায়ের নীচে সেই ৯৭তে শায়িত করে আসার পরপর বড় দাদাজানও তিন মাসের বেশী টেকেননি। রোজ নিজের ছোটভাই(আমার দাদাজান)য়ের কবরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কাঁদতেন, নাওয়া-খাওয়া হতো না।
…
হয়তো আমার দাদাজানের পাশাপাশি না হয়ে বরং খুব কাছাকাছিই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন প্রিয় আকমল চাচাজান। কেননা দাদাজানের পাশের জায়গাটুকু আমার প্রিয় দাদীজানের জন্য রাখা ছিলো। ঠিক তার আট বছর পর, আমার স্ট্রোকের পরপর দাদীজান সেটার স্বত্বঃত্যাগ করে দিয়েছেন, যদি আমিই তাঁর আগে বিদায় নেই তো ওটা …।
…..
শারীরিক কারনেই ওই সাক্ষাতের পরে আপনার সাথে আর দেখা করা হয়ে ওঠেনি, তাই বলে কি আমাকে এভাবেই ফাঁকি দিলেন?
…..
খুব কষ্ট পাচ্ছি চাচাজান। খুব কষ্ট। বাহিরে অঝোরে ঝরছে বারিষধারা, সাথে আমার চোখেও। জল নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাতেও কোন গন্ডগোল হচ্ছে মনে হয়।
…..
আল্লাহ আপনাকে ওপারে চিরশান্তিতে রাখুন। …